Saturday, December 5, 2009

নায়কের সাথে

বাড়ি ফেরার মিষ্টি অনুভূতির মাঝে বেশ বিস্বাদ তিরিশ ঘন্টার এই জার্নি। যদিও আশেপাশের নিদ্রাবিহীন ঈর্ষাকাতর সহযাত্রীদের বিরক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অধিকাংশ সময়টাই ঘুমিয়েছি, তবুও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষুদ্র ত্রুটিটুকুর সমালোচনা করার অধিকার ছাড়তে আমি বিন্দুমাত্র রাজি নই। ঘুমের আমেজটা না কাটলেও, প্লেন ল্যাণ্ড করা মাত্র নেমে পড়ার এক অতিব্যস্ততা কোথা থেকে যেন চেপে বসে। হয়ত সেটা "ক্যাট্‌ল ক্লাস" - এর আন্তর্জাতিক যাত্রীগরিমারই এক অঙ্গ। পেছনের সারির যাত্রি যদি আমার আগে অবতরণ করে, আমার পোর্টফোলিওতে কতটা লোকসান হবে তা না জানলেও, তাকে আগে নামতে দেওয়ার ঝুঁকিটা নিতে সাহস হয় না।



আগামী নয় ঘন্টা ট্রান্‌সিট প্যাসেঞ্জারের ভূমিকায় যে অভিজ্ঞতা হয় তার সাথে নিজের বিষ্ঠা হাতে প্যাথলজিকাল ক্লিনিকে লাইন দেওয়ার অনুভূতির বেশ মিল আছে। বিরক্তিকর, অথচ আবশ্যিক। এয়ারপোর্টের বাকি স্বদেশীয়দের মত আগে আমিও নিজের ক্যামেরাস্ত্র শাণিয়ে দাপিয়ে বেড়াতাম। সুন্দর মূর্তি থেকে ভর্তি ডাস্টবিন - সবই তখন ছিল বেশ আকর্ষক। দানবীয় চেহারার শ্বেতাঙ্গদের ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে নিজের বিভিন্ন ছবি তোলানোয় যে আনন্দ পেতাম, তা লর্ডসের বারান্দায় আঁদুল গায়ে গেঞ্জি ওড়ানোর থেকে কম ছিল না।



লাউঞ্জে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাচলার মাঝেই চোখে পড়ল একটা স্টারবাক্‌স্‌। লম্বা ফ্লাইটের বিনামূল্য আহারাদির একঘেয়েমি কাটাতেই লাইন দিলাম তার সামনে। সামনের বিশালায়তন লোকটাকে কেন জানি না বেশ চেনা চেনা লাগছিল। কিছুটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করার মতন অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম "হ্যালো"। লোকটি পিছন ঘুরতেই আমি স্তম্ভিত। সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় দত্ত - বোলে তো মুন্নাভাই। মগজের প্রসেসিং ইউনিটগুলো চালু হওয়ার আগেই জেগে উঠল পুরনো অভ্যেস। বিদ্যুৎবেগে ব্যাগ থেকে বের করে আনলাম ক্যামেরা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক আধাবৃদ্ধকে রীতিমত আদেশ করলাম আমার ছবি তুলে তার জীবন ধন্য করার জন্য। 'দিমাগ্‌ কি বাত্তি' তখন জ্বলে গেছে। সেই আলোয় ছকে ফেলছি অরকুট্‌, ফেসবুক, পিকাসার ভবিষ্যৎ অ্যালবামগুলো। ভদ্রলোক বিনা বিরক্তিতেই ছবি তুললেন। তার পারদর্শিতায় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে যাচাই করে নিলাম ছবিগুলো। ইতিমধ্যে প্রবাসীগরিমাও প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বলে বসলাম সঞ্জুবাবাকে - "তুমি চাইলে ছবিগুলো তোমাকে ইমেল করে দিতে পারি"। এই মাত্রার অর্বাচীনতায় অপ্রস্তুত হয়ে উনি বাধ্য হলেন একটি বিজনেস কার্ড খরচ করতে।



কফি নিয়ে দুজনেই বসলাম একটা টেবিলে। আমার কিছু অর্থহীন প্রশ্ন ও ওনার কিছু অর্থহীন দর্শন পারস্পরিকভাবে হজম করতে হচ্ছিল। কথায় কথায় জানতে পারলাম যে কোনো এক শুটিং এর দৌলতে শহরটা ভদ্রলোকের চেনা। ট্রান্‌সিট ভিসা নিয়ে শহর দেখতে বেরনোর উত্তেজনাটা আমার আবার একটু কম। তবু সঞ্জুবাবা জিজ্ঞেস করলেন - "বেরোবে নাকি শহরটা ঘুরতে?"

কিছুটা ভেবে বললাম - "ভিসা নিয়ে সমস্যা হবে না তো?"

- "তোমার আশা করি আমেরিকান ভিসা আছে। অসুবিধা হবে কেন?"

- সমস্যাটা আমায় নিয়ে নয়। আসলে আপনার টাডাজনিত ব্যাপারগুলো যদি এরা জানে ... "

সঞ্জুবাবা ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে জানালেন সেটা কোনো সমস্যাই না। অতএব অভিবাসনের বেড়া টপকে বেড়িয়ে পড়লাম সিটি ট্যুরে।



ঔদ্ধত্যের পারদ চড়চড়িয়ে বাড়তে লাগল। আমার ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার অপরাধে সঞ্জুবাবা এখন ফটোগ্রাফার। ল্যাণ্ডস্কেপ, পোর্ট্রেট এবং প্যানোরামিক ফটোগ্রাফির উপর জ্ঞানও দিতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর খিদেতা টের পেলাম। সামনেই ছিল একটা ভারতীয় রেস্তোঁরা। বাড়ির কাছাকাছি এসে অন্য কিছু খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। ঢুকে পড়লাম তাতেই।

রেস্তোঁরাটি পাঞ্জাবী। দেওয়ালে গুরু গোবিন্দ সিং-এর মুচকি হাসি দৃশ্যমান। কাউন্টারে অর্ডার দিয়ে টেবিলে এসে বসতেই চমকে উঠলেন নায়ক। উল্টোদিকের টেবিলে বসা এক সর্দারকে দেখে বলিউডের ম্যাচোম্যানের তখন এক ত্রস্ত চেহারা। কপালের টাক বেঁয়ে ঘামের ফোঁটাগুলো মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বকে প্রমাণ করছে। সর্দারজি উত্তেজিত হয়ে গুরমুখী ভাষায় লম্বা-চওড়া কিছু একটা বক্তব্য রাখামাত্র অন্য টেবিল থেকে আরও কিছু সর্দার উঠে দাঁড়াল। বক্তব্যটা না বুঝলেও আমার মনে হল যে কোনো সাউন্ডট্র্যাক চালিয়ে রেকর্ড করলে, বেশ খাসা ভাংড়া হিপহপ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। পরিস্থিতি অবশ্য বেশ গম্ভীর। সঞ্জুবাবাকে বিষয় বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করলাম। তাতে জানা গেল যে কোনো এক শুটিং-এর সময় সঞ্জুবাবা আর এই সর্দার একই হোটেলে ছিলেন। একদিন সুইমিং পুলের ধারে কোনো দুর্ঘটনাবশত সঞ্জুবাবার অন্তর্বাস সর্দারজির পাগড়ির ওপর স্থান পায়। ব্যাপারটা বেশ অসম্মানজনক মনে হওয়ায় সর্দারজি তার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সঞ্জুবাবা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে দুটোর ভূমিকা প্রায় একই। তাতেই এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেইবার প্রোডাকশন ইউনিটের বদান্যতায় কোনোরকমে নিস্তার পান। কিন্তু এবার মুক্তির আশা ক্ষীণ। মারমুখী সর্দারবাহিনী ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে।

সঞ্জুবাবা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অ্যাকশন হিরোগিরি বলিউডের সেলুলয়েডেই ফিক্সড ডিপোসিট করা আছে। সেটাকে ভাঙানোর দুঃসাহস করবেন না বলেই আমার ধারণা। কোনোরকমে পিছন ফিরে তিনি যে দৌড়টা দিলেন তা অনেকটা সবে ছেড়ে দেওয়া লোকাল ট্রেনের পিছনে লেট হওয়া নিত্যযাত্রীর দৌড়ের মতন। সেই সময় দরজা আগলে দাঁড়ালেন প্রৌড় হোটেল মালিক। একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতি। আমেরিকান ফুটবলের এটা খুব পরিচিত দৃশ্য। নায়ক কি পারবে বুড়োকে ডজ করে বেরোতে। এ এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। চোখের সামনে চলছে ব্রেকিং নিউজ, অথচ নিচে নেই শেয়ারমূল্যের টিকার। একটা চেয়ার তুলে নিয়ে চিৎকার করে বৃদ্ধ ছুটে এলেন সঞ্জুবাবার দিকে।

একটা বিকট শব্দে নড়েচড়ে বসলাম। আমার রুমমেট দরজায় জানান দিল যে সময়টা দুপুর দুটো। শুক্রবার রাতের ঘুমে কি যে মাদকতা আছে তা আজও বুঝিনা। ঘুম থেকে জেগে স্বপ্নের যে রেসিডুয়াল অংশটা পড়ে থাকে, তার থেকেই নিংড়ে বার করলাম উপরোক্ত "ট্রান্‌সিট প্যাসেঞ্জারের ডায়েরি"। নিজেকে কিছুটা ঝাড়পোছ করে আনমনেই বেরিয়ে পড়লাম স্টারবাক্‌সের উদ্দেশে। যদি মনে পড়ে ঠিক কি হয়েছিল শেষটায় ... নায়কের সাথে।