Saturday, April 14, 2012

বাজে বকা

মাঝে মাঝে মনে হয়, দিনের যতটা সময় বাজে বকে কাটাই, তার কিছুটা যদি সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করাতে কাটাতাম ... বেশ হত। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পরে কিছু বেকার ঐতিহাসিক যখন আমাদের ফেসবুক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের সাথে সেই দুর্বোধ্য লিপি পাঠোধ্যারের চেষ্টা করবে, বা কিছুটা লড়াইয়ের পর হাত তুলে দেবে, স্বর্গ বা নরকে আলসেমিভরে তা উপভোগ করতে খারাপ লাগবে না। স্বর্গ না নরক? কেন এই দ্বিধা? আজকাল নেত্রী বলছেন যে সবটাই সাজানো, ঠিক চেনা যাবেনা।

এটা উইকিপিডিয়া নয়। তাই বাজে বকার ব্যাপারে আর্টিক্‌ল ধরে ধরে তার ব্যাখ্যা, জন্মসাল, ব্যক্তিগত নষ্টামির হিসেব দিতে আমি দায়বদ্ধ নই। তেমনি আমি দায়বদ্ধ নই তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে, যাদের ক্রিয়াকর্মাদিকে খোরাকরূপে চিহ্নিত করে এক অনাবিল হাস্যরসের উৎস হিসেবে গণ্য করেছি। আজকাল তো উদাহরণ না দিলে বক্তব্য দাঁড়ায় না। কদিন আগেই ফেসবুকে দেখলাম জনৈক ব্যক্তি একটি ঘোষণা করেছেন, যার বাংলা তর্জমা করলে হয় - আজ আমি এক পুত্রসন্তানের গর্বিত পিতা হলাম। এক সদ্যজাত শিশুর কোন কীর্তিতে যে তার বাবা গর্বিত হল, তা বোঝা বেশ কঠিন। সে কোন পরীক্ষায় প্রথমও হয়নি, স্পোর্ট্‌সে মেডেলও জেতেনি বা ঢিল ছুড়ে কারুর মাথাও ফাটায়নি। সে ও তার পত্নী যে ফলনশীল, সে ছাড়া আর কোন গর্বের বিষয় খুঁজে পেলাম না। যাই হোক, এই ধরণের বিবৃতির অনুপস্থিতিতে বাজে বকাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আজকাল অবশ্য বাজে বকা নিয়ে চর্চা করার প্রচুর সময়। প্রযুক্তির আশীর্বাদে ও রিসেশনের ধাক্কায় আনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ কমেছে। যেমন নববর্ষ বা বিজয়ার অনাবশ্যক এস্‌এম্‌এস্‌ মোবাইলের ইনবক্স থেকে মুছতে হয় না। তারা আজকাল সময়ের বিবর্তনে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বাসা বেধেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে দেবদাসদের দুঃখের কাহিনী শুনে সান্ত্বনাও দিতে হয় না। তারা আজকাল স্বাবলম্বী হয়েছে। দু ঢোঁক গিলে, দু কলম দেবদাসী স্ট্যাটাস পোস্ট করে, কয়েকটা লাইক কুড়িয়েই তারা আজ বেশ খুশি।

এই বাজে বকা অবশ্যই মুড্‌কেন্দ্রিক। ছোট গল্প যেমন শেষ হয় না, এটা আবার মুড পাল্টালে হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন। আজকের যন্ত্রণার এখানেই ইতি। লেকিন জানে সে পেহ্‌লে ... শুভ নববর্ষ ১৪১৯।

Monday, February 6, 2012

হাজার লাইন করে আমি কোড লিখিতেছি ইন্টারনেট টুকে
সি, জাভা, এইচ্‌টিএমেলের ঝাঁ-চকচকে এডিটরে
অনেক ঘুমিয়েছি আমি, রেফারেন্স কোড পাওয়ার দারুণ সুখে
কিন্তু কী ক্যাঁচাল, সেই ডিবাগ্‌ করতে হল দিনরাত ধরে
আমি ক্লান্ত কোডার এক, চারিদিকে অন্তহীন রেকার্সিভ রুটিন
আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল উইন্ডোস্‌-এর ব্লুস্ক্রীন।

Wednesday, August 10, 2011

নামাবলি গায়ে মন্দিরে যাই, পাথরেতে মাথা ঠেকাই
তবু কোনদিনই যে তাঁর দেখা না পাই
আমি পথ হাঁটি মিছিলেতে, আমি প্রতিবাদী মর্মেতে
তত্ত্বের টক-ঝাল-মিষ্টি বুলি কপচাই
আমি জেনেছি এ জীবন মহান, তাই মনে রাখি কবির প্রয়াণ
শুধু ভুলে যাই ধূসর কোষের অস্তিত্ত্বটাই

Thursday, March 10, 2011

আমাকে আমার মতন থাকতে দাও

পাঞ্চলাইন হরণের স্বর্ণযুগে এই লাইনটা ধার না করে থাকতে পারলাম না। নিজের ইচ্ছেতে যতবার শুনেছি, তার চেয়ে ঢের বেশিবার অন্যের ঠেলায় শুনতে হয়েছে - সৌজন্যে কলার টিউন। কিন্তু এই লাইনটা রচনার প্রশংসা না করে পারছি না। এত নম্র ভদ্র আর্তির মোড়কে বেশ কড়া একটা মুখঝামটা লুকিয়ে আছে - 'নিজের চরকায় তেল দাও'।

রোজকার জীবনে এই লাইনটার প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। অফিসের কোনো বড় কর্তা যখনই দলগত সংহতি জাতীয় বক্তব্য রাখেন, কেন জানি না মনের ব্যাকগ্রাউন্ডে এই লাইনটা গমগমিয়ে বাজতে থাকে। নববর্ষ বা বিজয়ার পরে কিছু অপ্রয়োজনীয় আত্মীয়ের সাথে খেজুরে আলাপচারিতাতেও এই লাইনটা বেশ জ্বলজ্বলে। যখন অফিসফেরৎ ট্রেনে জানলার ধারের আলতো তন্দ্রাটা কোনো হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া বকবকে পরিচিতর অত্যাচারে বিপন্ন হত, এই লাইনটাই যেন অসহায় ভাবে হাতড়ে বেড়াতাম। সেই সময় না থাকুক, আজ তো আছে। সেই সমস্ত মানুষ যারা তাদের না-চাওয়া মতামতের ঝুড়ি নিয়ে সময়ে-অসময়ে বিব্রত করে বেরায়, তাদের মতুয়া নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে আমার আজকের হাতিয়ার - 'আমাকে আমার মতন থাকতে দাও'।

নিজেদের অলস সময়কে অন্যের জীবনের বিরক্তিতে রূপান্তরিত করা কিছু মানুষের জন্মগত প্রতিভা। এই প্রতিভারা পাটিল হলে হয়ত রাষ্ট্রপতি হতে পারত, কিন্তু বাতিল হওয়ায় এরা আজ মূর্তিমান ত্রাস। বিশেষত আমার মতন 'হ্যাপিলি সিঙ্গল' শ্রেণীর গোবেচারাদের জীবন আজ এদের দয়ায় বিপন্ন। অবিবাহিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের বিন্দুমাত্র ত্রুটি আবিষ্কার করতে না পারলেও, তাদের অস্তিত্ত্বে এদের ঘোর অস্বস্তি। ভাগ্যদেবীর বিরূপতায় এদের সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে বাঘের গলায় মালা পড়ানো বোধহয় অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। ঈশ্বরের দয়ায় আজ এদের ভাইরাল আক্রমণের বিরুদ্ধে আমার প্রতিষেধক - 'আমাকে আমার মতন থাকতে দাও', সঙ্গে মহীনের ঘোড়াগুলি থেকে ছোট্ট নোট, 'কখনও কি দেখেছ নিজেদের দিকে তাকিয়ে?'

Tuesday, December 21, 2010

থ্যাংক্‌স্‌ অ্যাণ্ড রিগার্ড্‌স্‌

ডিয়ার স্যার,

আশাকরি এই ইমেল আপনাকে আপনার স্বাস্থের শিখরে পাবে।

ঘাবড়াবেন না। আপনি কোনো লটারী জেতেননি, বা নাইজেরিয়ার কোনো বিধবা আপনার মারফৎ তার প্রয়াত স্বামীর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ট্রান্সফার করতে ইচ্ছুক নন। না না, বিট্‌টরেন্ট থেকে ডাউনলোড করার জন্য আইনি নোটিসও নয়।

এটি একটি বড়ই সাধারণ সৌজন্যমূলক ইমেল। জানি এবার কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন আজ থেকে ১৫ বছর আগে ১৫ পয়সার একটি পোস্টকার্ডে এমনই এক চিঠি পেলে কি খুশিই না হতেন। আরে আরে করছেন কি? ডিলিট বাট্‌ন থাকলেই কি সব বিরক্তি দূর হয় নাকি? শুক্রবার সন্ধ্যে ৭টায় মিটিং পড়লে পারেন ব্যবহার করতে এই বাট্‌ন? পড়ুনই না নাহয় এই কটা লাইন।

জানি আপনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই দেখে নিয়েছেন এই ইমেলের প্রেরক কোনো ফিমেল নয়। এটাও জানেন যে বাংলায় কর্মসংযোগমূলক ইমেলের সম্ভাবনা নিতান্তই অমূলক। নিমন্ত্রণী ইমেল হলে আয়োজক সাধারণত আগেই দিয়ে রাখে তার পূর্বাভাস। অতএব আপনার সিদ্ধান্ত বৃক্ষ (ডিসিশন ট্রি) অনুযায়ী এটি অবশ্যই একটি জাঙ্ক মেল।

কিন্তু এটা নিশ্চয়ই আপনাকে ভাবাচ্ছে যে আপনার ঠিকানা পেলাম কোথা থেকে। কোথায় কোথায় নিজের ইমেল আইডি রেজিস্টার করেছেন তা নিজেকেই ভাবতে হচ্ছে। মগজ অন্বেষণে গুগ্‌লের সাহায্য এখনও পাওয়া যায়নি। না না বেশি ভাববেন না। আমিই বলে দিচ্ছি। আপনার অতি মূল্যবান মস্তিষ্কের এই অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার ঘোর অপরাধ। এই ভাবনার ঠেলায় আমি চাই না যে প্রতিদিন অফিসে গিয়ে সবার আগে আপনি যে স্টক কোট্‌ গুলো দেখেন, তার একটিও বাদ যাক। বা যদি কোনো সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কারো সদ্য আপলোড করা ছবিতে কমেন্ট দিতে ভুলে যান, সে মহান দায় তো আমার ঘাড়েই চাপবে।

আমি জানি আপনি প্রচন্ড ডাইরেক্ট। এত গৌরচন্দ্রিকা সহ্য করতে পারেন না। তাহলে শুনুন। আমার পকেটে হঠাৎই একটি বিজ্‌নেস কার্ডে আপনার যোগাযোগগুলি পেলাম। আমি জানি আপনি আপনার বিজ্‌নেস কার্ড ব্যবহারে অতি যত্নবান। একটি কার্ডও প্রচন্ড প্রয়োজন ছাড়া খরচা করেন না। ব্যতিক্রমে মাঝে মাঝে কোনো রেস্টুরেন্টে খরচ করেন, কিন্তু তাওতো ঐ একটা মহামূল্যবান ফ্রি লাঞ্চের আশায়। তাছাড়া যেটুকু ব্যবহার করেন, তাতে আমার কাছে যে কার্ডটি আছে তার মতই অতি যত্নে নিজের ব্যাক্তিগত ইমেল আইডিটিও লিখে দেন।

এবার তাহলে আপনি ভাবছেন আমি কে? না না এবারেও ভাববেন না। কেননা ইতিমধ্যে অনেক ভেবেও আপনার মত মহামানবকে স্মরণ করতে পারিনি। আপনিও পারবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। এই ইমেলটিকে আপনার বিজ্‌নেস কার্ডের প্রাপ্তিস্বীকার হিসাবে গণ্য করতে পারেন।

অতি ধৈর্য ধরে আপনার এই ইমেল পাঠের জন্য রইল শেষ দুই শব্দ ...

থ্যাংক্‌স্‌ অ্যাণ্ড রিগার্ড্‌স্‌

Saturday, December 5, 2009

নায়কের সাথে

বাড়ি ফেরার মিষ্টি অনুভূতির মাঝে বেশ বিস্বাদ তিরিশ ঘন্টার এই জার্নি। যদিও আশেপাশের নিদ্রাবিহীন ঈর্ষাকাতর সহযাত্রীদের বিরক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অধিকাংশ সময়টাই ঘুমিয়েছি, তবুও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষুদ্র ত্রুটিটুকুর সমালোচনা করার অধিকার ছাড়তে আমি বিন্দুমাত্র রাজি নই। ঘুমের আমেজটা না কাটলেও, প্লেন ল্যাণ্ড করা মাত্র নেমে পড়ার এক অতিব্যস্ততা কোথা থেকে যেন চেপে বসে। হয়ত সেটা "ক্যাট্‌ল ক্লাস" - এর আন্তর্জাতিক যাত্রীগরিমারই এক অঙ্গ। পেছনের সারির যাত্রি যদি আমার আগে অবতরণ করে, আমার পোর্টফোলিওতে কতটা লোকসান হবে তা না জানলেও, তাকে আগে নামতে দেওয়ার ঝুঁকিটা নিতে সাহস হয় না।



আগামী নয় ঘন্টা ট্রান্‌সিট প্যাসেঞ্জারের ভূমিকায় যে অভিজ্ঞতা হয় তার সাথে নিজের বিষ্ঠা হাতে প্যাথলজিকাল ক্লিনিকে লাইন দেওয়ার অনুভূতির বেশ মিল আছে। বিরক্তিকর, অথচ আবশ্যিক। এয়ারপোর্টের বাকি স্বদেশীয়দের মত আগে আমিও নিজের ক্যামেরাস্ত্র শাণিয়ে দাপিয়ে বেড়াতাম। সুন্দর মূর্তি থেকে ভর্তি ডাস্টবিন - সবই তখন ছিল বেশ আকর্ষক। দানবীয় চেহারার শ্বেতাঙ্গদের ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে নিজের বিভিন্ন ছবি তোলানোয় যে আনন্দ পেতাম, তা লর্ডসের বারান্দায় আঁদুল গায়ে গেঞ্জি ওড়ানোর থেকে কম ছিল না।



লাউঞ্জে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাচলার মাঝেই চোখে পড়ল একটা স্টারবাক্‌স্‌। লম্বা ফ্লাইটের বিনামূল্য আহারাদির একঘেয়েমি কাটাতেই লাইন দিলাম তার সামনে। সামনের বিশালায়তন লোকটাকে কেন জানি না বেশ চেনা চেনা লাগছিল। কিছুটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করার মতন অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম "হ্যালো"। লোকটি পিছন ঘুরতেই আমি স্তম্ভিত। সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় দত্ত - বোলে তো মুন্নাভাই। মগজের প্রসেসিং ইউনিটগুলো চালু হওয়ার আগেই জেগে উঠল পুরনো অভ্যেস। বিদ্যুৎবেগে ব্যাগ থেকে বের করে আনলাম ক্যামেরা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক আধাবৃদ্ধকে রীতিমত আদেশ করলাম আমার ছবি তুলে তার জীবন ধন্য করার জন্য। 'দিমাগ্‌ কি বাত্তি' তখন জ্বলে গেছে। সেই আলোয় ছকে ফেলছি অরকুট্‌, ফেসবুক, পিকাসার ভবিষ্যৎ অ্যালবামগুলো। ভদ্রলোক বিনা বিরক্তিতেই ছবি তুললেন। তার পারদর্শিতায় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে যাচাই করে নিলাম ছবিগুলো। ইতিমধ্যে প্রবাসীগরিমাও প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বলে বসলাম সঞ্জুবাবাকে - "তুমি চাইলে ছবিগুলো তোমাকে ইমেল করে দিতে পারি"। এই মাত্রার অর্বাচীনতায় অপ্রস্তুত হয়ে উনি বাধ্য হলেন একটি বিজনেস কার্ড খরচ করতে।



কফি নিয়ে দুজনেই বসলাম একটা টেবিলে। আমার কিছু অর্থহীন প্রশ্ন ও ওনার কিছু অর্থহীন দর্শন পারস্পরিকভাবে হজম করতে হচ্ছিল। কথায় কথায় জানতে পারলাম যে কোনো এক শুটিং এর দৌলতে শহরটা ভদ্রলোকের চেনা। ট্রান্‌সিট ভিসা নিয়ে শহর দেখতে বেরনোর উত্তেজনাটা আমার আবার একটু কম। তবু সঞ্জুবাবা জিজ্ঞেস করলেন - "বেরোবে নাকি শহরটা ঘুরতে?"

কিছুটা ভেবে বললাম - "ভিসা নিয়ে সমস্যা হবে না তো?"

- "তোমার আশা করি আমেরিকান ভিসা আছে। অসুবিধা হবে কেন?"

- সমস্যাটা আমায় নিয়ে নয়। আসলে আপনার টাডাজনিত ব্যাপারগুলো যদি এরা জানে ... "

সঞ্জুবাবা ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে জানালেন সেটা কোনো সমস্যাই না। অতএব অভিবাসনের বেড়া টপকে বেড়িয়ে পড়লাম সিটি ট্যুরে।



ঔদ্ধত্যের পারদ চড়চড়িয়ে বাড়তে লাগল। আমার ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার অপরাধে সঞ্জুবাবা এখন ফটোগ্রাফার। ল্যাণ্ডস্কেপ, পোর্ট্রেট এবং প্যানোরামিক ফটোগ্রাফির উপর জ্ঞানও দিতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর খিদেতা টের পেলাম। সামনেই ছিল একটা ভারতীয় রেস্তোঁরা। বাড়ির কাছাকাছি এসে অন্য কিছু খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। ঢুকে পড়লাম তাতেই।

রেস্তোঁরাটি পাঞ্জাবী। দেওয়ালে গুরু গোবিন্দ সিং-এর মুচকি হাসি দৃশ্যমান। কাউন্টারে অর্ডার দিয়ে টেবিলে এসে বসতেই চমকে উঠলেন নায়ক। উল্টোদিকের টেবিলে বসা এক সর্দারকে দেখে বলিউডের ম্যাচোম্যানের তখন এক ত্রস্ত চেহারা। কপালের টাক বেঁয়ে ঘামের ফোঁটাগুলো মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বকে প্রমাণ করছে। সর্দারজি উত্তেজিত হয়ে গুরমুখী ভাষায় লম্বা-চওড়া কিছু একটা বক্তব্য রাখামাত্র অন্য টেবিল থেকে আরও কিছু সর্দার উঠে দাঁড়াল। বক্তব্যটা না বুঝলেও আমার মনে হল যে কোনো সাউন্ডট্র্যাক চালিয়ে রেকর্ড করলে, বেশ খাসা ভাংড়া হিপহপ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। পরিস্থিতি অবশ্য বেশ গম্ভীর। সঞ্জুবাবাকে বিষয় বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করলাম। তাতে জানা গেল যে কোনো এক শুটিং-এর সময় সঞ্জুবাবা আর এই সর্দার একই হোটেলে ছিলেন। একদিন সুইমিং পুলের ধারে কোনো দুর্ঘটনাবশত সঞ্জুবাবার অন্তর্বাস সর্দারজির পাগড়ির ওপর স্থান পায়। ব্যাপারটা বেশ অসম্মানজনক মনে হওয়ায় সর্দারজি তার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সঞ্জুবাবা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে দুটোর ভূমিকা প্রায় একই। তাতেই এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেইবার প্রোডাকশন ইউনিটের বদান্যতায় কোনোরকমে নিস্তার পান। কিন্তু এবার মুক্তির আশা ক্ষীণ। মারমুখী সর্দারবাহিনী ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে।

সঞ্জুবাবা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অ্যাকশন হিরোগিরি বলিউডের সেলুলয়েডেই ফিক্সড ডিপোসিট করা আছে। সেটাকে ভাঙানোর দুঃসাহস করবেন না বলেই আমার ধারণা। কোনোরকমে পিছন ফিরে তিনি যে দৌড়টা দিলেন তা অনেকটা সবে ছেড়ে দেওয়া লোকাল ট্রেনের পিছনে লেট হওয়া নিত্যযাত্রীর দৌড়ের মতন। সেই সময় দরজা আগলে দাঁড়ালেন প্রৌড় হোটেল মালিক। একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতি। আমেরিকান ফুটবলের এটা খুব পরিচিত দৃশ্য। নায়ক কি পারবে বুড়োকে ডজ করে বেরোতে। এ এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। চোখের সামনে চলছে ব্রেকিং নিউজ, অথচ নিচে নেই শেয়ারমূল্যের টিকার। একটা চেয়ার তুলে নিয়ে চিৎকার করে বৃদ্ধ ছুটে এলেন সঞ্জুবাবার দিকে।

একটা বিকট শব্দে নড়েচড়ে বসলাম। আমার রুমমেট দরজায় জানান দিল যে সময়টা দুপুর দুটো। শুক্রবার রাতের ঘুমে কি যে মাদকতা আছে তা আজও বুঝিনা। ঘুম থেকে জেগে স্বপ্নের যে রেসিডুয়াল অংশটা পড়ে থাকে, তার থেকেই নিংড়ে বার করলাম উপরোক্ত "ট্রান্‌সিট প্যাসেঞ্জারের ডায়েরি"। নিজেকে কিছুটা ঝাড়পোছ করে আনমনেই বেরিয়ে পড়লাম স্টারবাক্‌সের উদ্দেশে। যদি মনে পড়ে ঠিক কি হয়েছিল শেষটায় ... নায়কের সাথে।

Sunday, August 16, 2009

'কামিনে'

ভারতীয় চলচ্চিত্র নিঃসন্দেহে এক রেঁনেসার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার এক বলিষ্ঠ উদাহরণ বিশাল ভরদ্বাজের সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি 'কামিনে'। আম-আদমির গালাগাল যে সিনেমার টাইটেল হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা বোধহয় রাজ কাপুর - গুরু দত্তেরা কস্মিনকালেও ভাবেননি। তাদের দৌড় 'চোর', 'শরাবী', 'জংলী', 'জানোয়ার'-এই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাতেও হালফিলে 'চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা' জাতীয় নাম উঠে আসছে। আগামীদিনে চার-পাঁচ অক্ষরের শব্দগুলোও যদি সিনেমার নাম হয়ে ওঠে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এতে নির্মাতার কোনো দোষ দেখা যাচ্ছে না। 'কামিয়ে নে'-র ইঁদুরদৌড়ে টিকে থাকার জন্য কামিনে জাতীয় ক্যাপ্‌শন অবশ্যই এক মাস্টারস্ট্রোক।

কামিনে শব্দটার ব্যুৎপত্তি নিয়ে বিশেষ আলো দেখাতে পারব না। তবে বলতে পারি শব্দটার জনপ্রিয়তার পেছনে ধর্মেন্দ্র দেওলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কুকুররূপী কামিনেদের রক্তপানের যে লিপ্সা তিনি দেখিয়েছেন, তা আজও সারমেয়কুলে রূপকথা। অন্যান্য দ্বিতীয় শ্রেণীর শব্দকে ব্রাত্য করে নির্দেশক কেন কামিনেকে বেছে নিলেন সেটা আমি বুঝিনি। লোকে বলে একতা কাপুরের সমস্ত 'ক'-পূর্বক সিরিয়াল সফল হয়ে থাকে। বিশালজি হয়ত একতামাতার তুকতাককে অবহেলা করতে পারেননি।

সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু দুই যমজ ভাই - চার্লি ও গুড্ডু। এই মন্দার বাজারে দুই ভাইকে যমজ বানিয়ে এক অভিনেতা দিয়ে চালিয়ে দেওয়া বেশ যুক্তিপূর্ণ। যমজ ভ্রাতৃদ্বয়ের ভূমিকায় শাহিদ কাপূর। 'আঁখো মে তেরা হি চেহ্‌রা'-র ক্যাবলা চকোলেট মার্কা শাহিদ আর আজকের বাইসেপ ট্রাইসেপ মোড়া শাহিদ বেশ আলাদা। অক্ষয়কুমার, সঞ্জয় দত্ত, অক্ষয় খান্নাদের গুড়ি গুড়ি করে কাটা চুল বা আধা টাকের পাশে জন আব্রাহাম, শাহিদদের ঝাঁকড়া চুল নিশ্চয়ই কিছুটা বিরক্তি দূর করে। তাছাড়া নতুন প্রজন্মের এই তারকাদের প্রকৃত অভিনয়ের প্রতি যে অনীহা, সেটাও এক বৈচিত্র। ফেরা যাক সিনেমায়। গল্প আবর্তিত হয় দুই ভাইয়ের সম্পর্ক আর তাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। নিঃসন্দেহে নতুন কিছু নয়। তবু গল্পের পটবিন্যাস, চরিত্র রূপায়ন, সময়োচিত কামিনেপনা ও একটা সামগ্রিক বিনোদন সিনেমাটাকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।

চার্লি এক রেস্‌কোর্সের বুকি, জীবনের লক্ষ অবশ্যই শর্টকার্টে অর্থ উপার্জন। চার্লির দর্শন অনুযায়ী জীবনে দুটিই রাস্তা - শর্টকার্ট ও ছোট শর্টকার্ট। বাস্তব জীবনে আমিও খানিকটা এরকমই উপলব্ধি করেছি ... হৃদয়হরণা মেয়েদের দুটিই পোষাক - শর্টস্কার্ট ও ছোট শর্টস্কার্ট। চার্লির বস তিন বাঙালী উন্নাসিক ভাই যারায় পেশায় মাফিয়া। মেজ ভাইয়ের চরিত্রে রজতাভ দত্তের ছোট উপস্থিতি বাঙালীদের নিশ্চয়ই আনন্দ দেবে। চার্লি এক বিশেষ উচ্চারণজনিত সমস্যায় ভোগে - সে 'শ' কে 'ফ' উচ্চারণ করে। ভাগ্যিস কোনো বাঙালী এই রোগে ভোগে না। তাহলে তার জীবনে 'শাক' আর 'শার্ট' অনুচ্চারিতই থেকে যেত।

অন্য গোবেচারা ভাই গুড্ডু এক এন্‌জিওতে কাজ করে। তার সমস্যা তোতলামি। এন্‌জিওর এক ক্যাম্পেনে পতিতালয়ে নীরোধ বিলি করার সময় সে জানতে পারে যে নিজের অসুরক্ষিত সঙ্গমে পিতৃত্ব দরজায় কড়া নাড়ছে। তার প্রেয়সী (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) আবার 'জয় মহারাষ্ট্র' ধ্বজাধারী ভোপে ভাউর বোন। এক কোকেন স্মাগলিং এর ঘটনায় সব চরিত্র ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। হিন্দি সিনেমায় অধুনা স্মাগলিং এর মাধ্যম হিসেবে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। 'আঁখে' ছবিতে হারমোনিয়ামে টাকা লোকানো হয়েছিল। 'ঢোল'-এ তারা স্থান পেয়েছিল একটি ঢোলে। এবারে কোকেন পাচারের মাধ্যম ছিল একটি গীটার। গল্প যত ক্লাইম্যাক্সের দিকে গেছে, ততই আকর্ষক হয়েছে। মকবুল, ওঙ্কারার পর একটি ভিন্ন স্বাদের সিনেমা উপহার দেওয়ার জন্য বিশালজিকে ধন্যবাদ।

সিনেমার সুর বিশাল ভরদ্বাজেরই। মাচিস, সত্যা, ওঙ্কারা-র মত সুর না হলেও কিছু গান ভাল। হিন্দি গানের নতুন বিবর্তন নিঃসন্দেহে মোহিত চৌহান। সিল্ক রুটের 'ডুবা ডুবা'-র সাফল্য বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। প্লেব্যাকে প্রত্যাবর্তনের পর তার সমস্ত গানই মোটামুটি সুপারহিট। এই অ্যালবামে 'পেহলি বার মোহব্বত' গানটিও অসাধারণ। গুলজারের কথা সত্বেও গানের পাঞ্চলাইনে 'ঘপাক্‌', 'ঢন টনান' জাতীয় শব্দের ব্যবহার একটু হতাশ করেছে।

সামগ্রিকভাবে সিনেমাটি অবশ্যই বিনোদনে সফল। পাইরেসির বিরুদ্ধে যারা, তাদের মাথায় পড়ুক বাজ - এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়েও থিয়েটারে গিয়ে এই সিনেমাটি দেখায় কোনো আক্ষেপ নেই আমার। সস্তা যৌন কমেডির ভিড়ে না হেঁটে কামিনের এই প্রয়াস অবশ্যই প্রসংসনীয়।