Sunday, August 16, 2009

'কামিনে'

ভারতীয় চলচ্চিত্র নিঃসন্দেহে এক রেঁনেসার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার এক বলিষ্ঠ উদাহরণ বিশাল ভরদ্বাজের সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি 'কামিনে'। আম-আদমির গালাগাল যে সিনেমার টাইটেল হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা বোধহয় রাজ কাপুর - গুরু দত্তেরা কস্মিনকালেও ভাবেননি। তাদের দৌড় 'চোর', 'শরাবী', 'জংলী', 'জানোয়ার'-এই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাতেও হালফিলে 'চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা' জাতীয় নাম উঠে আসছে। আগামীদিনে চার-পাঁচ অক্ষরের শব্দগুলোও যদি সিনেমার নাম হয়ে ওঠে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এতে নির্মাতার কোনো দোষ দেখা যাচ্ছে না। 'কামিয়ে নে'-র ইঁদুরদৌড়ে টিকে থাকার জন্য কামিনে জাতীয় ক্যাপ্‌শন অবশ্যই এক মাস্টারস্ট্রোক।

কামিনে শব্দটার ব্যুৎপত্তি নিয়ে বিশেষ আলো দেখাতে পারব না। তবে বলতে পারি শব্দটার জনপ্রিয়তার পেছনে ধর্মেন্দ্র দেওলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কুকুররূপী কামিনেদের রক্তপানের যে লিপ্সা তিনি দেখিয়েছেন, তা আজও সারমেয়কুলে রূপকথা। অন্যান্য দ্বিতীয় শ্রেণীর শব্দকে ব্রাত্য করে নির্দেশক কেন কামিনেকে বেছে নিলেন সেটা আমি বুঝিনি। লোকে বলে একতা কাপুরের সমস্ত 'ক'-পূর্বক সিরিয়াল সফল হয়ে থাকে। বিশালজি হয়ত একতামাতার তুকতাককে অবহেলা করতে পারেননি।

সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু দুই যমজ ভাই - চার্লি ও গুড্ডু। এই মন্দার বাজারে দুই ভাইকে যমজ বানিয়ে এক অভিনেতা দিয়ে চালিয়ে দেওয়া বেশ যুক্তিপূর্ণ। যমজ ভ্রাতৃদ্বয়ের ভূমিকায় শাহিদ কাপূর। 'আঁখো মে তেরা হি চেহ্‌রা'-র ক্যাবলা চকোলেট মার্কা শাহিদ আর আজকের বাইসেপ ট্রাইসেপ মোড়া শাহিদ বেশ আলাদা। অক্ষয়কুমার, সঞ্জয় দত্ত, অক্ষয় খান্নাদের গুড়ি গুড়ি করে কাটা চুল বা আধা টাকের পাশে জন আব্রাহাম, শাহিদদের ঝাঁকড়া চুল নিশ্চয়ই কিছুটা বিরক্তি দূর করে। তাছাড়া নতুন প্রজন্মের এই তারকাদের প্রকৃত অভিনয়ের প্রতি যে অনীহা, সেটাও এক বৈচিত্র। ফেরা যাক সিনেমায়। গল্প আবর্তিত হয় দুই ভাইয়ের সম্পর্ক আর তাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। নিঃসন্দেহে নতুন কিছু নয়। তবু গল্পের পটবিন্যাস, চরিত্র রূপায়ন, সময়োচিত কামিনেপনা ও একটা সামগ্রিক বিনোদন সিনেমাটাকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।

চার্লি এক রেস্‌কোর্সের বুকি, জীবনের লক্ষ অবশ্যই শর্টকার্টে অর্থ উপার্জন। চার্লির দর্শন অনুযায়ী জীবনে দুটিই রাস্তা - শর্টকার্ট ও ছোট শর্টকার্ট। বাস্তব জীবনে আমিও খানিকটা এরকমই উপলব্ধি করেছি ... হৃদয়হরণা মেয়েদের দুটিই পোষাক - শর্টস্কার্ট ও ছোট শর্টস্কার্ট। চার্লির বস তিন বাঙালী উন্নাসিক ভাই যারায় পেশায় মাফিয়া। মেজ ভাইয়ের চরিত্রে রজতাভ দত্তের ছোট উপস্থিতি বাঙালীদের নিশ্চয়ই আনন্দ দেবে। চার্লি এক বিশেষ উচ্চারণজনিত সমস্যায় ভোগে - সে 'শ' কে 'ফ' উচ্চারণ করে। ভাগ্যিস কোনো বাঙালী এই রোগে ভোগে না। তাহলে তার জীবনে 'শাক' আর 'শার্ট' অনুচ্চারিতই থেকে যেত।

অন্য গোবেচারা ভাই গুড্ডু এক এন্‌জিওতে কাজ করে। তার সমস্যা তোতলামি। এন্‌জিওর এক ক্যাম্পেনে পতিতালয়ে নীরোধ বিলি করার সময় সে জানতে পারে যে নিজের অসুরক্ষিত সঙ্গমে পিতৃত্ব দরজায় কড়া নাড়ছে। তার প্রেয়সী (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) আবার 'জয় মহারাষ্ট্র' ধ্বজাধারী ভোপে ভাউর বোন। এক কোকেন স্মাগলিং এর ঘটনায় সব চরিত্র ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। হিন্দি সিনেমায় অধুনা স্মাগলিং এর মাধ্যম হিসেবে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। 'আঁখে' ছবিতে হারমোনিয়ামে টাকা লোকানো হয়েছিল। 'ঢোল'-এ তারা স্থান পেয়েছিল একটি ঢোলে। এবারে কোকেন পাচারের মাধ্যম ছিল একটি গীটার। গল্প যত ক্লাইম্যাক্সের দিকে গেছে, ততই আকর্ষক হয়েছে। মকবুল, ওঙ্কারার পর একটি ভিন্ন স্বাদের সিনেমা উপহার দেওয়ার জন্য বিশালজিকে ধন্যবাদ।

সিনেমার সুর বিশাল ভরদ্বাজেরই। মাচিস, সত্যা, ওঙ্কারা-র মত সুর না হলেও কিছু গান ভাল। হিন্দি গানের নতুন বিবর্তন নিঃসন্দেহে মোহিত চৌহান। সিল্ক রুটের 'ডুবা ডুবা'-র সাফল্য বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। প্লেব্যাকে প্রত্যাবর্তনের পর তার সমস্ত গানই মোটামুটি সুপারহিট। এই অ্যালবামে 'পেহলি বার মোহব্বত' গানটিও অসাধারণ। গুলজারের কথা সত্বেও গানের পাঞ্চলাইনে 'ঘপাক্‌', 'ঢন টনান' জাতীয় শব্দের ব্যবহার একটু হতাশ করেছে।

সামগ্রিকভাবে সিনেমাটি অবশ্যই বিনোদনে সফল। পাইরেসির বিরুদ্ধে যারা, তাদের মাথায় পড়ুক বাজ - এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়েও থিয়েটারে গিয়ে এই সিনেমাটি দেখায় কোনো আক্ষেপ নেই আমার। সস্তা যৌন কমেডির ভিড়ে না হেঁটে কামিনের এই প্রয়াস অবশ্যই প্রসংসনীয়।

Sunday, August 2, 2009

NABCর ডায়েরি - গা গরম

নিশ্চিন্তেই ছিলাম ... NABC যাত্রাপালার এখনো একদিন বাকি। ফোর্সড্‌ শাটডাউনের সুখ ল্যাদ সহকারে উপভোগ করছিলাম। হঠাৎই জেগে উঠল প্রযুক্তির অন্যতম অভিশাপ - মোবাইল ফোন। হাজিরা দিতে হবে কনভেনশন সেন্টারে। NABCর দোরগোড়ায় কর্মকর্তাদের গলায় যে পরিমাণ উচ্ছ্বাস তা বোধহয় স্বাধীনতার প্রাক্কালে নেহেরুও অনুভব করেননি। কেউ যদি কোনো Startup খুলতে চান, তাদের জন্য আমার একটা আইডিয়া আছে। এমন একটা ওষুধ বার করুন যা মানুষকে NABC কর্মকর্তাদের কাছাকাছি এনার্জি লেভেলে নিয়ে যাবে। একটা নামও ঠিক করেছি - নায়াগ্রা (Ref-ভায়াগ্রা)।

পৌছে গেলাম গ্রাউন্ড জিরোতে। মকবুল ফিদা হুসেনকে যদি ক্লাউড কম্পিউটিং এর সেমিনার শোনাতে বসানো হত, তিনি হয়ত অনুভব করতে পারতেন আমার মনের অবস্থাটা। ঢোকার মুখেই সাজানো রেজিস্ট্রেশন কাউন্টার। কিছু নওজওয়ানকে দেখলাম উৎসাহভরে ওয়েলকাম কিট গোছাচ্ছে। তাদের মধ্যে এক চিনা মেয়েও আছে। বং টং শুনে সে হয়ত চিনের সাথে কোন আত্মিক সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে। মোদ্দা কথা NABCর দখলে 'চাঁদনী চক টু চায়না'।


যে দলটার সাথে কাজ করতে হবে তারা সিনেমা দেখানো, সাহিত্য সম্মেলন জাতীয় কিছু রাজকার্য করবে বলে ভেবেছে। চন্দ্রবিন্দুর ভাষায় 'অনাবাসী ঢং'। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে থিয়েটার গুলি দেখে নেওয়ার। থিয়েটার বলতে একটি চিনা ডিভিডি প্লেয়ার, একটি সস্তার প্রোজেক্টর আর একটি সাদা থান। হয়ত বাংলা সিনেমার সাম্প্রতিক বৈধব্যের প্রতীক।

খাওয়া দাওয়া শেষে দেখা মিলল NABCর আবিষ্কার 'হিমান'-এর সাথে। এই সামান্য ব্লগে হিমানের পরিচয় দেওয়া বাতুলতা। এই মুহূর্তে তার পরিচয় বিজনেস ফোরামের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ কর্মকর্তা। যাইহোক বিশেষ কাজে নেমে এলাম লাগোয়া হিল্টন হোটেলের লবিতে। এসে পৌছেছেন কলকাতার প্রতিভারা। কবি, গায়ক, অভিনেতাদের এই অটোগ্রাফহীন উপস্থিতি চোখ টানতে বাধ্য। এক জনপ্রিয় গায়ক-কাম-নির্দেশক রীতিমত স্পিন খেতে খেতে লিফটে উঠে পরলেন। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের কমপ্লিমেন্টারি ড্রিঙ্কসের প্রভাব হয়ত। এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে রেজিস্ট্রেশনের বিশয়ে সাহায্য চাইতেই হিমানের ব্যস্ততা-সূচক চড়তে লাগল। জানতে পারলাম উনি প্রখ্যাত সাংবাদিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা শহরতলীর ট্রেনে নিত্য যাতায়াতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যেভাবে উনি তিন কলামের চটুল গল্পের সাহায্যে সান্ধ্য প্রতিদিনের বিক্রি বাড়িয়ে তুলেছেন, তা হ্যারি পটারের লেখিকার চেয়ে কম কৃতিত্বের নয়।

সন্ধ্যা ঘনাতেই বিজনেস ফোরামের ককটেল পার্টিতে মহারথীদের ভিড় বাড়তে লাগল। হিমান মহারাজও ওয়াইনের কৃপায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে। হিল্টনের বাইরের অঘোষিত স্মোকিং জোনে হিমান উপলব্ধি করল যে কলকাতাবাসীদের সাথে ওর আলাপ করা উচিত। সামনেই ছিলেন তবলাবাজিয়ে তন্ময় বোস। অতএব তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে হিমান বলে উঠল - Hey! Let's mingle! তবলায় চাটি মেরে যার অভ্যেস, কাঁধে হিমানের চাটা খেয়ে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। আধা বাংলা ও আধা ইংরাজিতে যা বললেন তার সারাংশ হল যে উনি মোটেই Mingleবাজ নন। মনমরা হিমান তবলচির এই প্রতিবাদ হজম করার জন্য পুনরায় বারের দিকেই রওনা দিল।

পেটের ভিতর একটা অস্বস্তিতে টনক নড়ল। ঘড়ির কাঁটায় খিদে উঁকি মারছে। বুঝলাম বাংলার কমরেডদের সাথে এদের তফাত কোথায়। ব্রিগেডের সভায় অন্তত সিঙ্গারা লাড্ডুর প্যাকেট জোটে। এখানে শুধুই কিছু 'প্রবাসী' সঙ এর অ্যাক্‌সেন্ট। ততক্ষণে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট। আগামী তিন দিন যে কেউ এই গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কনভেনশন সেন্টারের রাক্ষুসে পার্কিং চার্জ মিটিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির পথে। মনের মধ্যে তখন কমপ্লেক্স সুডোকু - পালাবার এখনো কি কোনো রাস্তা আছে? কানের পাশে কোনো এক অ্যাংরি ইয়ংম্যান যেন বলে উঠল - 'NABC সে বচ্‌না মুশকিল হি নহী, নামুমকিন হ্যায়'।